পরিচালকের ব্যাখা তলব, চেয়ারম্যানের নির্দেশনা আসতে পারে (পর্ব-২)

চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে ভারী লাইসেন্স জালিয়াতি, ক্যাশিয়ার বহাল, চলছে ঘুষ লেনদেন

Passenger Voice    |    ০৯:৩৭ এএম, ২০২২-১০-১০


চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে ভারী লাইসেন্স জালিয়াতি, ক্যাশিয়ার বহাল, চলছে ঘুষ লেনদেন

নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ  প্রতিটি ভারী মোটরযান চালানোর জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে ১ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চুয়াডাঙ্গা সার্কেল। চলতি বছরের ২৮ ও ২৯ মে এবং ১৮ ও ১৯ জুন ৪ দিনে ভয়াবহ এই জাল জালিয়াতি করেন এই সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আইনুল হুদা। ৪৫ টি ভারী মোটরযান চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে ৪৫ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন করেছেন তিনি, সে টাকায় বিআরটিএর চট্টমেট্রো-২ সার্কেলের উপপরিচালকের দায়িত্ব ভাগাতে লেনদেন করছেন এমনটায় তথ্য অনুসন্ধ্যান করে প্যাসেঞ্জার ভয়েস গত ০৩ অক্টোবর “ উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য ঘুষের যোগান: ভারী মোটরযানের ভয়ঙ্কর লাইসেন্স জালিয়াতি চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে" শিরোনামে অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

সংবাদ প্রকাশের পূর্বে চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএর ভারী লাইসেন্স জালিয়াতির তথ্য প্রমাণসহ  প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধান টিমের সাথে কথা হয়েছিল বিআরটিএর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মাসুদ আলমের সাথে। প্রাথমিক অনুসন্ধান করতে চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। তবে অস্পষ্ট ২০০১ সালের এক আদেশ দেখিয়ে পরিচালক কে বোকা বানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা সার্কেলের সহকারী পরিচালক সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী। এতে তদন্ত না হয়ে ধামাচাপা পরে যায় বিষয়টি। তবে সংবাদ প্রকাশের পরে আর থেমে থাকেন নি বিআরটিএর খুলনা বিভাগের এই পরিচালক। গত ৬ অক্টোবর নং-বিআরটিএ/পরি/খুবি/২০২২/৬৩০ নং সংখ্যক স্বারক মূলে এই ভারী লাইসেন্স জাল জালিয়াতির বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করেছেন তিনি।

বিআরটিএর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মাসুদ আলম প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমি বিষয়টি আপনাদের কাছে জানার পরে চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে পরিদর্শনে যায়। এবং এই বিষয়ে সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আইনুল হুদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তিনি আমাকে ১২-০৩-২০০১ সালের নং-বিআরটিএ/৭৭এ(অংশ-১)/৯৮-৪৭৭ (৮৫) নং সংখ্যক স্বারক মূলে তৎকালিন বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. আজিজুল হক ভুইয়ার জারিকৃত সার্কুলার অনুযায়ী ২০০৭ সালে বিআরটিএর তৎকালীন সহকারী পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়ার সময়ে ইস্যু করা লাইসেন্স এর বয়স সংশোধন করেছেন বলে জানিয়েছেন। 

তবে বিআরটিএতে কখনো সরাসরি ভারী মোটরযানের লাইসেন্স ইস্যুর সুযোগ ছিল কিনা, অথবা ২০০৭ সালে ভারী মোটরযানের লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তিটির প্রথম হালকা মোটরযানের লাইসেন্স কত সালে প্রথম বিআরটিএ ইস্যু করেছিল এবং কত সালে সেটা মধ্যম মোটরযানের লাইসেন্স হিসেবে ক্যাটাগরি পরিবর্তন করা হয়েছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য সেই সময়ে এই পরিচালককে দেয়নি সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আইনুল হুদা। এছাড়াও ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিটি চালকদের বিপরীতে ভারী মোটরযানের লাইসেন্স ইস্যুর জন্য তৎকালিন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যে আদেশ দেয়া হয়েছিল সে আদেশ মূলে এই লাইসেন্স গুলো ইস্যু হয়েছে কিনা সে বিষয়েও স্পষ্ট বক্তব্য দেয়নি। তবে ধরে নেয়া যায় ১৯৯৬ সালে জন্ম গ্রহন করা ব্যক্তিদের ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সালের মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশে তাদের নাম ছিল না। ঘুষ বাণিজ্য ও জাল জালিয়াতির জন্য বিআরটিএর চেয়ারম্যানের ২০০১ সালের সার্কুলারের কপি যেহেতু তিনি সংরক্ষণ করেছেন সেহেতু তার কাছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এই আদেশের কপি থাকাও স্বাভাবিক। তবে সূত্র বলছে এবারের ব্যাখ্যা তলবে এডি আইনুল হুদাকে এই সব প্রশ্নের জবাব ও দিতে হবে। তবে চতুর এই সহকারী পরিচালক প্রতিটি চিঠি কৌশলে ২ টি করে তৈরি করে রাখেন। কর্তৃপক্ষকে যে সময়ে যেভাবে বোকা বানানো যায় সেই কাজটি করেন তিনি। 

এমন দুইটি চিঠি রয়েছে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের হাতে। যে গুলো তিনি পাঠিয়েছিলেন বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) লোকমান হোসেন মোল্লাকে। একই স্বারক ও একই তারিখ এবং একই সময়ে স্বাক্ষর করা দুইটি চিঠিতে রয়েছে নানান রহস্য। বোঝার স্বাধ্য নেই এই চিঠি গুলোর কোন অংশে পরিবর্তন করা হয়েছে। বিআরটিএর চেয়ারম্যানের সদয় অবগতির জন্য অনুলিপি দেয়া আছে দুই চিঠিতে, রয়েছে খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (ইঞ্জিঃ) এর অনুলিপির কপিও। তবে এই বিষয় গুলো সম্পর্কে জানতে প্যাসেঞ্জার ভয়েস চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএর অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কেউ মুখ খুলেনি এই বিষয়ে। 

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সূত্র বলছে, মরিয়ম খাতুন নামের এক নারী বিআরটিএর চুয়াডাঙ্গা সার্কেলে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড এর এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করতেন। মাত্র ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা এই নারী তার ছোট অসুস্থ সন্তান ও বেকার স্বামীকে নিয়ে কোন রকম জীবন পার করছিলেন। বিআরটিএর সহকারী পরিচালক আইনুল হুদা তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের জাল জালিয়াতি করার প্রস্তাব দিতেন। তবে তার এই প্রস্তাবে সাই দেয়নি মরিয়ম খাতুন। তখনই তার ঘুষ আদায়ের ক্যাশিয়ার জাকির হোসেন সাথে পরামর্শ করে কৌশলে এই নারীর নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়ার কলা কৌশল তৈরি করেন। এবং তিনি সফলও হয়েছেন। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মরিয়ম খাতুন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ও তার পরিবারের কেউ প্যাসেঞ্জার ভয়েসের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে জাকির হোসেনের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্থ এক সহকর্মীর কাছ থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু তথ্য।

বিআরটিএ সদর কার্যালয় থেকে পাওয়া একই স্বারক ও একই তারিখ এবং একই সময়ে স্বাক্ষর করা সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) আইনুল হুদার দুইটি চিঠির রহস্য এবার প্রকাশ্যে। চিঠি গুলো ছিল মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড এর এক্সিকিউটিভ মরিয়ম খাতুন কে কৌশলে চাকরি থেকে বের করে দেয়ার।  চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা থানার বন্ডবিল এলাকার মো. তাহের মন্ডল এর পুত্র মো. মুকুল হোসেন জন্ম ২৫-০৭-১৯৭১ খ্রিঃ যার প্রথম ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু ৩০-১২-১৯৯৩ রেফারেন্স নং- চড০৩৫৯১২৩ভ। কুষ্টিয়া বিআরটিএর ইস্যু করা এই লাইসেন্স পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা ওডি-৩৯২/২০০১ রেফারেন্সে ইস্যু করা হয়। যার লাইসেন্স নং-২৮৫১৮/৯৩। এই লাইসেন্সটি ২০২২ সালে চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএতে নবায়ন করতে আসলে নন স্মার্ট কার্ড এর ডাটা এন্টির সময় রেফারেন্স নং- CHOD392/ 2001 এর স্থানে ভুলে CHOD392/ 2021 লিপিবদ্ধ করা হয়। বিষয়টি অবগত হয়ে ফাইলটি সরিয়ে রেখে কৌশলে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) লোকমান হোসেন মোল্লাকে ০৫/০৯/২০২২ খ্রিঃ তারিখে অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে মরিয়ম খাতুন জাল জালিয়াতি করতে মর্মে উল্লেখ করে । সহকারী পরিচালকের চিঠি অনুযায়ী শ্রম আইনকে বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে কোন ধরনের তদন্ত ছাড়া একই তারিখ থেকে মরিয়ম খাতুনকে চাকরি থেকে বের করে দেয় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড। পরবর্তীতে ০৭/০৯/২০২২ খ্রিঃ তারিখে মরিয়ম খাতুন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুম) এর সুপারিশ সম্বলিত একটি পত্র প্রেরণ করেন মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের এইচ আর ম্যানেজার আশরাফ বিন মতুর্জাকে। এর পরে কৌশলে একই স্বারক ও একই তারিখ এবং একই সময়ে স্বাক্ষর দেখিয়ে পূর্বের চিঠিতে শুধুমাত্র Remarks - Ref No-CHOD392/2001 Name- Mukul Hossan, Vehicle: Heavy, Driving License exist in the volume সংযুক্ত করে আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে দেন। তবে কৌশলে নিজে বাঁচলেও চাকরি বহাল হয়নি মরিয়ম খাতুনের। তবে শ্রম আইন অমান্য করে ইচ্ছে মতো চাকরি থেকে বের করে দেয়ায় মরিয়ম খাতুন মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

ক্যাশিয়ার জাকির হোসেন বহাল তবিয়তে, চলছে ঘুষ লেনদেন ঃ

গাড়ির গতিরোধে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করতে ১৯৪২ সালের মোটরযানের বিধি মোতাবেক স্পীড গভর্নর সীল কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করতো বিআরটিএর। গাড়ি প্রতি একটি বিল নিয়ে সীল করাটা ছিল তাদের কাজ। পরবর্তীতে তারা হয়ে  উঠে বিআরটিএর অফিসারদের ঘুষ লেনদেনের ক্যাশিয়ার। কারন এখন কোন গাড়ী গতিসীমার জন্য সীল করা হয়না। আর সীল করার সেই সীসাও এখন আমদানি নেই বাংলাদেশে। যদিও বর্তমানে এই পদের কোন কাজ বিআরটিএতে নেই, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনেও এই বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে। সেই সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএ অফিসটি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন স্পীড গভর্নর সীল কন্ট্রাক্টর জাকির হোসেন। যদিও নতুন আইনে তাকে নবায়ন করার কোন সুযোগ নেই। 

দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে এই এলাকার দালালদের নিয়ন্ত্রণ, বহিরাগত দালালদের সাথে যোগাযোগ, মোটরসাইকেল রেজিষ্ট্রেশনের ফাইল, ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ফাইল নেয়া। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের ঘরের বাজার সদায়, মাদকসেবী কর্মকর্তাদের মাদকদ্রব সাপ্লাইসহ চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএর প্রতিটি কাজের ঘুষের বাজার দর ও নির্ধারণও করেন এই জাকির হোসেন। বর্তমান সহকারী পরিচালক তাকে বিআরটিএ কার্যালেয়ে একটি রুম বরাদ্ধ দিয়ে তার ঘুষের লেনদেন চালানোর জন্য পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন। সেই রুমে চলে আবার কর্মকর্তাদের ঘুষর ভাগভাটোয়ারা। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে খুলনা বিভাগীয় পরিচালক-উপপরিচালকরা এই জাকির হোসেন কে বিআরটিএ থেকে বের করতে পারেন না। সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও এই সার্কেলের সহকারী পরিচালক আইনুল হুদা তার ঘুষ বাণিজ্য চলমান রাখতে এই জাকির হোসেনকে দিয়ে সমস্ত দাপ্তরিক কাজ সম্পাদন করাচ্ছে। এই জাকির হোসেন মেয়াদোত্তীর্ণ সীল কন্ট্রাক্টরের নিয়োগপত্র নিয়ে সার্কেলের অফিসে সমস্ত অপকর্ম চালাচ্ছে। এই সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক ,মেকানিক্যাল এসিস্টেন্ট, অফিস সহকারী সবাই জিম্মি এই জাকির হোসেনের কাছে। সংবাদ প্রকাশ ও পরিচালকের তদন্তের পরেও এখনও বহাল এই জাকির।